Wednesday, June 22, 2011

মুখোমুখি...........***************.............(ছোটগল্প)

আজ আমার মনটা খুব ভালো।অনেক ভেবে চিন্তে একটা
সিদ্ধান্তে এসে পৌছেছি।শিহরিত হচ্ছি ভেবে যে অবশেষে আমি চুড়ান্ত সিদ্ধান্তে এসে পৌছাতে পেরেছি।খুনটা আমাকে আজই করতে হবে।অনেক জ্বালা সয়েছি।অনেক অপমানিত হয়েছি।একটা ছাইচাপা আগুন আমাকে দিনের পর দিন পুড়িয়ে মেরেছে।এজন্য আমাকে একটা বিহিত করতেই হোত।তাই সকাল সাড়ে দশটায় ওর হাতে তৈরি এককাপ চা খেয়ে বাসা থেকে বের হলাম আমি-উদ্দেশ্য আন্দরকিল্লা।
হ্যাঁ এতক্ষণ যার কথা বলছি সে আর কেউ নয়- আমার স্ত্রী- মিলি। অপরুপ সুন্দরীর স্কেল যদি বানানো যেত তাহলে মিলি তাতে একশোতে একশো পেতো।আর আমার মতো এক চালচুলোহীন যুবক মিলির মতো এক মেয়েকে বউ হিসেবে পেয়ে হাতের মুঠোয় আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছিলাম যেন।বন্ধুমহলে হয়ে গেলাম ফ্লপ থেকে সুপারহীরো।জানতামনা মিলির অপরুপ সৌন্দর্য আমার জীবনের কাল হয়ে দাড়াবে।জীবনটা করে দেবে বিষাক্ত......
হেঁটেই এলাম আন্দরকিল্লা।পাঠকবন্ধু লাইব্রেরী আর তাজ সায়েন্টিফিক স্টোর ফেলে এগিয়ে গেলাম একটা গোপন স্থানে।একটু অন্ধকার এলাকা সেটা। নিয়নবাতি গুলো যেন ইচ্ছা করেই নষ্ট যেখানে।সন্ত্রাসী- আর চাঁদাবাজদের আস্তানা নামেই পরিচিত এলাকাটা।এখানেই মেঘারানী নামে এক মহিলা থাকেন।আপাতদৃষ্টিতে দেখে অতিসাধারন মহিলা মনে হলেও আসলে মহিলা অস্ত্র পাচারকারি দলের সদস্য।এই নষ্ট অন্ধকারে থেকে থেকে নিজের ভালো নামটাও ভুলে গেছে মেঘা।আর সেই মেঘার কাছেই আমার গন্তব্যের শেষ।
অনেকদিন আগে মেঘারানীর সাথে আমার পরিচয়।তখন আমি কলেজে পড়ি। একদিন কলেজ থেকে হেঁটে আসার পথে আন্দরকিল্লা মোড়ের আগে চিৎকার চেঁচামেচি শুনে এগিয়ে গিয়ে দেখি একটা কুয়াকে ঘিড়ে জনাবিশেক লোক জড়ো হয়ে আছে।আমি ওদের আগ্রহ সর্ম্পকে জানতে গিয়ে কুয়ার উপর চোখ ফেলে দেখি একটা বছর দশেকের বাচ্চা ছেলে কুয়ার মাঝে হাবুডুবু খাচ্ছে-আর সম্ভবত ছেলেতার মা কুয়ার পাশে দাড়িয়ে সাহায্য চেয়ে চিৎকাট করে বিলাপ করছে।আর তখন আমার মাঝে বিদ্যুত খেলে গেল।আমি কোনরকমে জুতাজোড়া খুলে কুয়ার দড়িটা ধরে দিলাম কুয়ার মাঝে লাফ।আর ছেলাটাকে কোনরকমে উপরে তুলে ই আমি বেহুঁশ।
দুইদিন পর হাসপাতালে জ্ঞান ফিরলে মেঘা তার ছেলেকে নিয়ে আমাকে দেখতে আসে। সেই থেকে মেঘার সাথে আমার পরিচয়।সেইদিন সবাই আমার সাহসের তারিফ করলেও আমি নিজেই নিজের সাহস দেখে অবাক হয়ে গেছিলাম।আর আজকের সাহসটা আমার একটু বেশিই।কারণ মেঘার কাছ থেকে একটা ফাইভস্টার আর এক ম্যাগাজিন গুলি নিয়ে আমি রওনা দিলাম চকবাজারের দিকে।
চকবাজারের হোটেল পাব-ইন এ গিয়ে একটানা চার পেগ হুইস্কি গিললাম।মাথাটা একটু চক্কর মেরে উঠতেই উঠে পড়লাম পাব থেকে।এদিকে বেলা একটা বেজে পচিঁশ।আমি সোজা রওনা দিলাম বাসার উদ্দেশ্যে।
বাসায় ফিরতেই মিলি আমাকে ঠান্ডা সরবত খেতে দিল।এই গরমে সরবতটা আমার কাছে বেহেস্তের সেরাব বলে মনে হোল।ইজিচেয়ার এ বসে বসে ভাবছি কি করবো। মিলি তখন রান্নাঘরে।ইলিশের মাথার মুড়িঘন্ট আর পোলাওএর দারুন গন্ধ নাকে এসে লাগছে।মনে আমার সুখ সুখ অনুভুতি হচ্ছে।ও বোধহয় বুঝতে পেরেছে আমাকে ওর শেষ রান্না করা খাবার খাওয়াচ্ছে।তাই বুঝি আমার প্রিয় খাবার গুলাই আজকের রেসিপি.......
এমনভাবে মিলিকে খুন করতে হবে আমি জীবনে ও ভাবিনি।দুবছর আগেও ওর রান্না করা খাবার না খেলে আমার চলতোনা।প্রতিদিন ওর হাতের পায়েশ না খেলে আমার রাত পোয়াতোনা।প্রতিদিন কোন না কোন বন্ধু আমার অতিথি হোত খাবার টেবিলে।বেশ সুখের ছিলো দিন গুলো।
বিয়েটা করেছিলাম বছর চারেক আগে-ঠিক আজকের দিনে।দিনে বিয়ে-রাতে বাসর।বাসর রাতে ঐ চাঁদ মুখ দেখে বলেছিলাম-ঐ মুখের জন্য মরতে ও আমার দ্বিধা হবেনা।
হায় মানুষের জীবন কিভাবে পরিবর্তন হয়ে যায়...যে মিলির জন্য আমি প্রাণ দিয়ে দিতে পারতাম-তাকে খুন করার জন্য আমার হাত মিশ মিশ করছে!!!
আমাদের সুখের সংসারের কারনে আমার বন্ধুমহলে হিংসার পাত্র হয়ে উঠেছিলাম।একদিন এক পার্টিতে সাজ্জাত বলেছিল -"তোর বউটাকে যদি একবার পেতাম রে..........''
নেশার ঘোরে আমি বলেছিলাম-''আরে আমা বউ তো তোর ও বউ...........................''
নেশার ঘোরে বলা সেই কথাটাই আজ জান্তব সত্যি।আমার স্ত্রী মিলির সাথে বাল্যবন্ধু সাজ্জাতের ...............
ছি: কি লজ্জ্বা.....................................
একটা প্রাইভেট ফার্ম খুলেছিলাম আমি আর সাজ্জাত মিলে।স্থাপত্যে আমরা বুয়েটের দ্বার পেরিয়ে এসেছি বছর তিনেক আগে।ভালোই চলছিলো আমাদের ফার্ম-কিন্তু একদিন আমার করা একটা বাড়ির নকশা নিয়ে কথা কাটাকাটি লেগে গেল আমাদের।কথা কাটাকাটি থেকে হাতাহাতি-এবং মারামারিতে জড়িয়ে গেলাম আমরা।অফিসের বাকি লোকজন এসে না থামালে আমি সেদিন খুন হয়ে যেতাম।একটা কাঁচের বোতল ছুড়ে মেরেছিলো আমাকে সাজ্জাত।অল্পের জন্য বেঁচে গেছি সেদিন।
স্যরি কথাটা আমি খুব কম বলি।কাউকে স্যরি বলতে গেলেই গলায় আটকে যায় শব্দটা।কিন্তু সাজ্জাতের বেলায় বার বার স্যরি বলাও আমি ক্ষমা পাইনি।
তারপর আমার পরিবারিক জীবনে নেমে আসে ধস্‌।মিলি আর আমার সন্তান হচ্ছেনা এই ধারনা নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেলাম।অনেকগুলো টেষ্ট করালাম দুইজনে।টেষ্টে মিলির কিছু ধরা না পড়লেও আমার টেষ্টের ফলাফল -আমি অক্ষম..........
একদিকে মিলির অদম্য মাতৃ ইচ্ছা-অন্যদিকে নিজের অক্ষমতা আমাকে পাগল করে তুলল।ভাবতে ভাবতে আমার মাথায় টেষ্ট টিউব বেবি নেয়ার কথা মাথায় আসলো-তখন আমি আবিষ্কার করি -মিলি অন্য কোন পুরুষের সাথে পরকিয়া করছে...আর সেই পরুষটা হোল সাজ্জাত...........
একদিন দেখি সাজ্জাত আমার বাসা থেকে বেরিয়ে আসছে...আমার মুখোমুখি হতেই একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে আমাকে পাশকাটয়ে চলে গেল সামনে দিয়ে।আমি দৌড়ে গেলাম বাসার ভেতর।দেখলাম মিলি শুয়ে আছে সোফায়....আলুথালু বেশে....আমি নির্বাক...যেন এতটুকু দেখার বাকি ছিল আমার.....

এ ঘটনার মাস দুয়েক পর একদিন-মিলি হটাৎ করে অজ্ঞান হয়ে পড়ল।আমি তাড়াতাড়ি ডাক্তার ডাকলাম।ডাক্টার পরীক্ষা নীরিক্ষা করে বললেন...আমি বাবা হতে চলেছি......

মিলি প্রেগনেন্ট................ছি!!!!!!!!!
কিন্তু মিলিকে কিছু বলার অধিকার যে আমি হারিয়েছি অনেক আগেই।কি বলবো??? মা তো সবাই হতে চায়।কিন্ত স্বামীর অক্ষমতা কি কোন নারী সহ্য করবে??এই বুকে যতটানা অক্ষমতার জ্বালা-তার চেয়ে ও বেশী ভালোবাসতে না পারার জ্বালা।
তারপর নয়মাস পর যখন সাজ্জাত এসে মিলির কোল থেকে নবজাতক কে কোলে তুলে নিলো তখন আমি আর সহ্য করতে পারিনি।আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলাম-তা ও পারিনি কাপুরুষ ছিলাম বলে।নিজের কেনা বাড়িতে নিজেকে অনাহুত হয়ে পড়ে থাকটে হোল।সাজ্জাতের সাথে মিলির অবাধ মেলামেশা-যখন তখন বাইরে বেরিয়ে যাওয়া-ইত্যাদি ইত্যাদি আমাকে অচ্ছুত ই করে তুলল
ডির্ভোসের কথা বলেছিলাম মিলিকে।ও রাজি হয়নি।আমি ই একদিন মিলির নামে লিখে দিয়েছিলাম সব সম্পত্তি।আর তাই সে ডির্ভোসে রাজি হোল না।আমার সামনে আমার বউ আরেক জনের সাথে থাকবে-শুবে-ঘুরবে-আড্ডা দিবে-রাত কাটাবে-আর আমি সহ্য করবো?
তাই বেছে নিলাম আজকের দিনটা।আজই যা করার তা করতে হবে।মিলিকে আজ আমি খুন করবোই।
খটাং করে একটা ধাতব শব্দ হল।মিলির স্নান শেষ।মাথায় নীল টাউয়েল পেঁচিয়ে মাথা মুছতে মুছতে আমার দিকে আসতে লাগল মিলি।ঐ সুন্দর মুখটার ভেতর যে কি বিষাক্ততা লুকিয়ে আছে ঈশ্বর জানেন।
আমাকে খাইয়ে দাইয়ে নিজে খেতে গেল সে।ঠিক যেন দুইবছর আগের সেই মিলি।শুয়ে পড়লাম আমি।
একি আমি ঘুমিয়ে পড়ছি??? আমি কি ভুলে যাচ্ছি আমার প্রতিজ্ঞার কথা???নাহ-কোমড়ে হাত দিতেই পিস্তলটা তার অস্তিত্ব জানান দিল।
সাইলেন্সার টা ভালো ভাবে লাগিয়ে আমি রেডি হয়ে শুয়ে থাকলাম।আয়নায় নিজের চেহারার দিকে তাকিয়ে দেখলাম।চেহারায় কি ভয় লুকিয়ে আছে???
নাহ-ভয় পেলে চলবেনা।ট্রিগারটা যায়গামতন টিপে দিলেই খেল খতম।ঐ নষ্টা মেয়েটাকে আজ আমাকে খুন করতেই হবে
বাথরুম থেকে বেরিয়ে এল মিলি।আঁচলে কিছু একটা লুকোনো।যাকগে মারবো তো আমি।ভাবতে ভাবতে বাথরুমে ঢুকলাম।মারার পর লাশটাকে কর্ণফুলিতে চালান দিয়ে দেবো...আর ঐ পাপের সন্তানটাকে ছুড়ে ফেলবো রাস্তায়।এসব ভাবতে ভাবতে বেরিয়ে এলাম বাথরুম থেকে।হাতের ভাঁজে পিস্তল।
''একদম নড়বেনা....নড়লেই খুলি উড়িয়ে দিব.....''
হাতে ঠিক আমারই মত একটা পিস্তল।কোথায় পেল ওটা???আমার মাথায় চিন্তার ঝড়.....আমি ও বের করে আনলাম আমার পিষ্তলটা।
''ও তুমি ও আমাকে মারতে চাও???ওটা হবেনা সোনা..'' হিশ হিশিয়ে উঠল মিলি।
নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে আমি মিলির কপালে নিশানা করলাম।দুজনের হাতেই পিস্তল..একদিন দুজনে দুজনকে ভালোবেসে মরার পরিকল্পনা করেছিলাম।আর আজ আমরা দুজন দুজনার মুখোমুখি....সামনা সামনি.....ভালোবাসা নয়....পিস্তল হাতে....দুজন দুজনাকে খুন করবো বলে....................................................।




নষ্ট কবি

২০০৪ইং

No comments:

Post a Comment