Saturday, July 16, 2011

ছোট গল্প ███ দম ███ ███উৎসর্গ সেই ৪৭ জন শিশুদের যারা নির্মম ভাবে বিদায় নিয়েছে পৃথিবী থেকে ███

দম ১৫-০৭-২০১১

“কিরে আইসক্রিম এখনো খাসনাই তুই?” লালচে লেবেঞ্চুস টা মুখে নিয়ে আরেকবার চুকচুক শব্দ করে চুষে মিষ্টি রসটুকু মুখে টেনে নিয়ে সোহানকে বলল লিটন।

সকাল থেকে সোহানের মন খারাপ। মা বাবার জন্য কেন যেন খুব খারাপ লাগছে। অনেক দিন আগে ওর দাদি মারা যাবার পর এরকম খারাপ লেগেছিল। কেমন যেন বুকের মাঝে প্রচন্ড চাপ অনুভব করছে সে। কিন্তু কেন হচ্ছে সেটা নিজেই বুঝতে পারছেনা সোহান। আর কোনদিন এমন বোধ হয়নি সোহানের। ক্লাসে প্রতি বছর প্রথম স্থানটা সোহানের থাকে। তাই ওর মা বাবা সংসারের অভাব ওকে বুঝতে দেন না। যখন যা দরকার হয় হাতের কাছেই যেন পায় সে। বাবা সামান্য একটা বেতনের কেরানী র চাকরী করেন। কিন্তু প্রতিদিন হাতে করে ছেলের জন্য ফলমূল নিয়ে আসেন।

কিন্তু আজ সকালে খেলা দেখতে যাবে বলে মাকে বলতেই মা খেকিয়ে ঊঠেন। একমাত্র ছেলেকে কোনদিন কাছছাড়া করেন না। একমাত্র ছেলে বলে আদরের চাইতে শাসন একটু বেশী করেন তিনি। ছেলে কেঁদে ফেলতেই তাই কেন যেন মন না চাইতে ও যেতে দিলেন। অনেক দিন ধরে সোহান একটা ফুলহাতা রঙ্গীন সার্ট খুঁজছিল স্কুলে পড়ার জন্য। প্রতি মাসেই এটা ওটা কিনতে গিয়ে সোহানের সার্ট কিনে দেয়া হয়না।

গতমাসে সোহান কে কথা দিয়েছিলেন প্রথম সাময়িক পরীক্ষায় প্রথম হলে কিনে দেবেন একটা সার্ট। কিন্তু কিনে দেয়া হয়নি। তাই আজ ফুটবল খেলা দেখতে যাবে বলতেই যেতে দিলেন তিনি।

সোহানের হাতের আইসক্রিম টা প্রায় শেষ হাতের মাঝেই।এমন সময় কে যেন চিৎকার করে ঊঠল গোল গোল বলে। চারপাশের ছেলে গুলো তার সাথে গলা মিলিয়ে চিৎকার শুরু করে দিল। রোহান আর মাকসুদ জামা খুলে বাতাসে ঊড়াতে ঊড়াতে মাঠের মাঝে দৌড় দিল। সোহান আর লিটন আস্তে আস্তে মাঠের মাঝে হেটে গেল। লিটন হাতের লেবেঞ্চুস টা চুষতে চুষতে হাটতে লাগল সোহানের সাথে।সেটা প্রায় শেষ করে বলল-

“ইস কি গরম পড়ছে দেখসস? তোর মত একটা আইসক্রিম খাওয়া দরকার ছিল। হুদাই আমি লেবেঞ্চুস টা খাইলাম- দেখ কেমন বুক পিঠ ভিজা গেছে গরমে”।

গরগর করে বলে চলেছে লিটন- সোহানের সেদিকে হুশ নাই- কেমন যেন মন্ত্র মুগ্ধের মত হেটে হেটে ছেলেদের পিছু নিয়েছে। লিটনের ও মন খারাপ হয়ে গেল এটা দেখে।

বৃষ্টির দিন। আকাশে কালো মেঘ নেই- তুলো তুলো মেঘে ভর্তি। অবশ্য সবাই খুশি হয়েছিল বৃষ্টি না হওয়াতে- খেলাটা ঠিক মত শেষ হয়ে গেল বৃষ্টি ছাড়াই। যদিও বা শেষ মুহূর্তে একটা অফসাইডে বাঁশি বাজিয়ে রেফারি বিপদে পড়ে গিয়েছিল প্রায়-কিন্তু সেটাকে অনেকেই আমলে নিলনা সোহানদের স্কুলের কেঊ।

খেলা প্রায় শেষের পথে। পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্টান প্রায় শেষ। সোহান সেই আগের মতই মনমরা। লিটন বেচারা সোহানের হাত ধরে দাঁড়িয়ে দাড়িয়ে দূর থেকে পুরস্কার বিতরণী টা দেখল। কাছে যেতে পারলনা। সোহান কে কেঊ যেন মাটির সাথে পেরেক দিয়ে আটকে দিয়েছে।
সবাই নাচতে নাচতে মাঠ ঘুরে ঊঠতে লাগল ট্রাকে। কোন রকমে ট্রাকের এক কোনায় সোহানকে তুলে দিয়ে নিজেও ঊঠে পড়ল ট্রাকে। আস্তে আস্তে ট্রাকে ছেলেরা উঠতে শুরু করল। ছেলেদের সংখ্যা ক্রমে বাড়ছে। প্রথমে ঊঠার কথা ছিল ৪০ জনের। শেষে দেখা গেল প্রায় ৯৪ জন উঠে গেছে।

অনেকক্ষণ হল ট্রাক কেঊ চালাতে আসছে না। এদিকে ট্রাকে বসেই অনেকে বিজয় মিছিল করছে। গরমে ভিজে ঊঠেছে সবার শরীর। সোহান আর লিটন ট্রাকের কোনায় উঁচু ঘেরার পাশে কোন রকমে ছায়ার মাঝে বসে আছে।

অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর ছেলেরা চিৎকার চেচামেচি শুরু করল- ট্রাক ছাড়ার জন্য। কেউ একজন এসে ট্রাক ছাড়ল প্রায় এক ঘণ্টা পর।ট্রাক ছাড়তেই কেউ একজন গান ধরল-
গাড়ি চলেনা চলেনা চলেনা রে
গাড়ি চলেনা-


সবাই সুরে সুরে গেয়ে ঊঠল। লিটন ও গাইতে শুরু করল। শুধু সোহানের কোন দিকেই খেয়াল নেই। ওর কেন যেন খুব কষ্ট লাগছে। কেঊ হয়ত খেয়াল করেনি- ওর চোখ বেয়ে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল ওর মায়ের মুখ টা কল্পনা করে – কেন কে জানে।

ট্রাক আস্তে আস্তে গাড়ির গতি বাড়ছে। ছেলেদের গানের সুর ও পরিবর্তন হয়ে চলেছে একের পর এক। ওদের মাঝে সবচেয়ে সুরেলা কন্ঠ সুমনের।ও একের পর এক গান গেয়ে মাতিয়ে রেখেছে সবাইকে। এখন গান ধরল-
গেরামের নওজোয়ান- হিন্দু মুসলমান
মিলিয়া বাঊলা গান আর ঘাটু গান গাইতাম
আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম আমরা
আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম


সবাই যখন গেয়ে চলেছে- হটাত সোহান দাঁড়িয়ে গেল বসা থেকে। আগেই কয়েকজন দাঁড়িয়ে ছিল বসতে না পেরে। এখন ওর সাথে সাথে লিটন ও দাঁড়িয়ে গেল। সবাই মিলে হাত তালি দিচ্ছে গানের তালে তালে। কিন্তু সোহান এক নজরে তাকিয়ে আছে ড্রাইভারের দিকে। আর তখন ই ড্রাইভারের মোবাইলে একটা কল আসল।

মোবাইল টা বাম হাতে ধরে কথা বলতে বলতে এক হাতে স্টিয়ারিং চালাতে শুরু করল ড্রাইভার। আর তাতেই ট্রাক টা কেমন যেন হলে দুলে ঊঠল আশে পাশের গাড়িকে সাইড দিতে গিয়ে। একটা ছোট টেম্পো কে সাইড দিতে গিয়ে কেমন যেন খেই হারিয়ে ফেলল সে।

একটু পর আবার সব ঠিক। কয়েকজন দাঁড়িয়ে ড্রাইভারকে কথা না বলে গারি চালাতে বল্লেও ড্রাইভার কারো কোথায় কান দিল না। যারা দাঁড়িয়েছিল তারা আস্তে আস্তে বসে গেল। কিন্তু সোহান বসল না। সে এখন ও তাকিয়ে আছে ড্রাইভারের দিকে। কেন যেন মনে হচ্ছে ওর আজ কিছু একটা হবে। খুব খারাপ একটা কিছু- কিন্তু কি হবে সেটা বুঝতে পারছেনা যেন।

এমন সময় ট্রাক টা একটা সরু নদীর ঊপরের একটা ছোট ব্রিজের ঊপর ঊঠল। এখনো ফোনে কথা বলছে চালক। এবং চোখের পলকে এদিক ওদিক টলতে টলতে হটাত ট্রাক কাত হয়ে গেল। একপাশ থেকে বাম পাশে যারা বসে ছিল তারা এক ঝটকায় এসে পড়ল ডান পাশে। এবং তাতেই ঊল্টে গেল ট্রাক- সোজা পড়তে শুরু করল নদীর মাঝে। দাঁড়িয়ে ছিল সোহান- হটাত তার মনে হল যে যেন অযুত বছর ধরে ঊল্টো হয়ে পড়ে চলেছে। সবাই যেন ঝুলছে তার মত নিচে পড়ে যাবার অপেক্ষায়। কিন্তু সময় শেষ হচ্ছেনা। চোখে অন্ধকার দেখতে শুরু করল সোহান।

হটাত চোখ থেকে কালো পরদা সরে গেল যেন সোহানের। চোখ মেলে ই দেখল নিচে কাদা- ওর প্রায় অর্ধেক কাদার মাঝে ঢুকে গেছে। হাত দিয়ে চাপ দিয়ে ঊঠবে সে ঊপায় ও নেই। যেন এক মৃত্যু কুপ। চাপ পাশে অন্ধকার- পুরো ট্রাক ঊল্টো খোপের মত করে পড়েছে- সবাই সেই খোপে বন্দী। শুধু একটা দিক খোলা। সোহান আর লিটন বসেছিল সামনের দিকে- কিন্তু এখন ওরা প্রায় পেছনে। সামনে র দিকের ছেলে গুলো বের হতে না পারলে ওরা কেউ বের হতে পারবেনা। কিন্তু এর মাঝে ট্রাক ডুবতে শুরু করেছে। আস্তে আস্তে দম বন্ধ হয়ে আসছে সোহানের। পাশে কোন রকমে ফিরে দেখল অনেক আগেই কাদার মাঝে ডুবে লিটন মারা গেছে। কোন নড়া চড়া নেই।

হাত দিয়ে প্রিয় বন্ধুকে বাচাবে সেই উপায় নেই।আস্তে আস্তে নিজে ডুবতে শুরু করল সোহান। পুকুরে সাঁতার কাটার ওস্তাদ সে- কিন্তু কখনো কাদার মাঝে এভাবে বেকায়দার পড়েনি। প্রথমে পা ডুবল- তারপর আস্তে আস্তে কোমর ডুবতে শুরু করেছে। ভয়ে চিৎকার করে কেঁদে ফেলল সোহান- কিন্তু কিছু করার নাই। আশে পাশে সবার একই অবস্থা।

এখন সোহানের শুধু নাকটা ডুবে যাবার বাকি। কয়েক সেকেন্ড পর সেটাও ডুবে গেল- আস্তে আস্তে দম বন্ধ হয়ে আসছে সোহানের। মায়ের মুখটা খুব মনে পড়ছে ওর। এখন কিছুই করার নেই। কাদার মাঝে নড়াচড়া করার শক্তি ও প্রায় শেষ।অবশেষে প্রচন্ড ঘুম পেল তার- আস্তে আস্তে নিস্তেজ হবার আগে হয়ত আরেকবার চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল ওর মা বাবার মুখ দুটো...

(সমাপ্ত)

No comments:

Post a Comment