Saturday, October 29, 2011

████বলয় ████রহস্য- রোমাঞ্চ- ভৌতিক গল্প

বলয়////// ০৫-১০-২০১১

ব্যাপারটা আমি খেয়াল করেছিলাম যেদিন আমি জেলখানায় ফাঁসির আসামী সুলেমান এর সাথে শেষ দেখা করতে গেলাম। সুলেমানের ব্যাক্তিগত উকিল আমি। তাই প্রতিবার মামলা চলার সময় আমাকে সুলেমান এর সাথে দেখা করে মামলা নিয়ে আলোচনা করতে হত। সেই থেকে সুলেমান এর সাথে আমার বন্ধুত্ব। কি? ভাবছেন কিভাবে একজন ফাঁসির আসামীর সাথে আমার মত একজন উকিলের বন্ধুত্ব হতে পারে? ফাঁসির আসামী হতে পারে- খুন করতে পারে সে- কিন্তু তার ভেতর বাস করে একজন অন্যরকম মানুষ। এই ভেতরের মানূষটাই আমাকে টেনেছিল। দীর্ঘ দুই বছর ওর সাথে মামলা নিয়ে কথা বলতে বলতে বুঝেছি ওর মত ভাল মানূষ হয়না। জ্ঞান হবার পর থেকে এক ওয়াক্ত নামাজ সে কাজা করেনাই। একটা রোজা ও সে ভাঙ্গে নাই স্বেচ্ছায়। কিন্তু সব কিছুর পর ও সে একজন খুনি। নিজের মুখেই স্বীকার করেছে সে খুনের কথা। আমি ও প্রমান পেয়েছি। তাই শেষ পর্যন্ত ওকে আমি বাঁচাতে পারিনি- কিনবা মন থেকেই চাইনি একজন খুনি বেঁচে যাক। ওর নিজে থেকেই আমি সাই পাইনি। তাই আমি ও বেশী দিন ওর জন্য মামলায় সাক্ষি জোগার করে নিজেকে নিজের কাছে অপরাধী করতে চাইনি। ওর যখন ফাঁসির আদেশ হয়- নিজে থেকেই মেনে নিয়েছিলাম। এই শেষ সময়ে আমি তাই ওর সাথে দেখা করতে চাইনি। কিন্তু ও বিশেষ ভাবে ডেকে পাঠায় আমাকে। আমি যেতে চাইনি। একজন খুনির ফাঁসি হবে সে জন্য না- একজন ভাল মানূষের ফাঁসি হবে সে জন্য যেতে চাইনি ওর সামনে। সেদিন ঠিক বারোটা এক মিনিট এ সুলেমানের ফাঁসি হবে জানতে পেরে শেষ ইচ্ছা জানিয়েছে একান্তে আমাকে কিছু কথা বলতে চায়।

আমি পৌছাতেই পুলিশ আমাকে কয়েকটা বড় বড় সেল পার করে রেস্ট্রিক্টেড এড়িয়াতে নিয়ে যায়। সেখানে রাজনৈতিক নেতা এবং ফাঁসির আসামীদের হেপাজতে রাখা হয়। আমি যাওয়ার আগেই আমার কালো গাউন আর ফাইল পত্র বাইরে রেখে আসতে হল। রেখে আস্তে হল আমার চশমাটাও। কোন ভাবেই যেন সুলেমান আমাকে মেরে ফেলতে না পারে। বাইরে দুইজন গার্ড দাঁড়িয়ে থাকবে-এর মাঝেই আমাকে বলতে হবে একান্ত কথা। এটাই এখানকার নিয়ম।

আমি পৌছাতেই দুইটা তালা আর একটা কম্বিনেশন লক খুলে আমাকে সুলেমানের সেলে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে আবার লক করে দেয়া হল দরজা। রুমের ভেতর বেশ ছিমছাম পরিবেশে সুলেমান বসে আছে। পরিপাটি বিছানা। পাশেই একটা কমোড আর একটা বেসিন। খাটের উপর পদ্মাসনে বসে ছিল সুলেমান। আমি যেতেই আমাকে ইশারায় সামনে বসতে বলল সুলেমান। আমি বসলাম ওর সামনে।

"তোমাকে একটা কথা বলার জন্য ডেকেছি আমি" - চোখ বন্ধ করেই বলতে লাগল সুলেমান।

"তোমার কাছে আজ পর্যন্ত আমি কিছু লুকাইনি । তুমি জান আমি কাকে কিভাবে মেরেছি। কিন্তু অনেকবার জানতে চাইলে ও কেন মেরেছি সেটা আমি তোমাকে বলিনি। তুমি তো জানো আমি খুন করেছিলাম আমার বাল্য বন্ধু শাহজাদ কে। ওর সাথে আমি একসাথে কাটিয়েছি অনেক গুলো বছর। একসাথে লেখা পড়া করেছি। যেদিন আমি ওকে মেরে ফেলি ঠিক তার তিন দিন আগে আমি ওর মাথার ইঞ্চি তিনেক ঊপরে একটা হাল্কা আলোর রেখা দেখতে পাই। ওকে সেটা বলতেই ও হেসে উড়িয়ে দেয়। দুইদিন পর আমি ওর মাথার উপর সেই আলোর রেখা আবার দেখতে পাই। সেটা তখন আলোর বলয়ের মত হয়েছিল। ভালভাবে তাকাতে সেই বলয়ের ভেতর আমি সোনালী আলোর রেখা ও দেখতে পাই। ওকে আমি আবার ও জানাই সেই কথা। ও আমার কথা আবার হেসে উড়িয়ে দেয়। সব সময় খানিক টা ফাজিল টাইপের ছিল । আমাকে নিয়ে ফাজলামি শুরু করে দিল সে। হটাত আমার মাথাটা খারাপ হয়ে গেল কেন যেন। কথাকাটাকাটি শুরু হয়ে গেল। সেই কথাকাটাকাটির এক পর্যায়ে আমি শাহজাদের গলা চেপে ধরি। কিন্তু বুঝিনি সে মরে যাবে। পাঁচ ফুট আট ইঞ্চির বিশাল দেহের শাহজাদ আমার সাথে জোর জবরদস্তি করতেই পারলনা। মরে গেল আমার চোখের সামনেই। আর সাথে সাথে মাথার উপর থেকে বলয় টা অদৃশ্য হয়ে গেল নিমিষেই।

আমি সেদিন বুঝিনি আলোর বলয় টা কি ছিল। কিন্তু এখন আমি বুঝতে পেরেছি সেটা কি ছিল। আমার মামলা চালানোর সময় আমার বন্ধু শাহজাদের স্ত্রির উকিল সামসুল সাহেবের কথা আপনার মনে আছে? মামলা চলার সময় উনি হটাত হার্ট এটাকে মারা গেলেন- পরে আরেকজন উকিল আসল উনার যায়গায়। সেই সামসুল সাহেবের মাথায় ও দেখেছিলাম আমি সেই বলয়। মৃত্যুর ঠিক একদিন আগেই আমি সেই বলয়ের ভেতর সোনালী বলয়ের রেখা ও দেখেছিলাম।পরের দিন উনার মৃত্যু সংবাদ শুনেই বুঝেছিলাম সেই বলয় ছিল মৃত্যু বলয়। আমি কোন একভাবে টের পেতে শুরু করেছি এই বলয়। এটা সবাই দেখেনা। কেউ কেউ দেখে। কিন্তু মানুষকে জানায় না। কেউ হয়ত মাথায় বলয় নিয়েই ঘুরছে- কিন্তু জানেই না মৃত্যু তার সমাগত।

তোমাকে এই লূকানো সত্য কথাটা বলার জন্যই ডেকেছিলাম - এখন তুমি যাও "- বলেই চুপ মেরে গেল সুলেমান। আমি ও নিরবে ত্যাগ করলাম ওকে। সেই সময় ওকে মনে মনে বদ্ধ পাগল বলে চলে যেতে যেতে কি মনে করে পিছন ফিরেই দেখেছিলাম সুলেমানের মাথার ঠিক তিন ইঞ্চি উপরে একটা হালকা আলোর বলয়। আমি চোখ বন্ধ করে আবার তাকালাম। দেখলাম কিছু নেই সেখানে। বুঝে নিয়েছিলাম আমারই চোখের ভুল। পাগলের সাথে থাকলে নিজের ভেতর ও কিছুটা পাগলামি চলে আসে ভাবতে ভাবতে চলে আসি সেদিন।

ঠিক তিন দিন পর আমি আজকে আমি বউ কে নিয়ে বেড়াতে বের হয়েছি।বিয়ের পনের বছর উপলক্ষে আমাদের এই সিলেট ভ্রমণ। আমার মেয়ে সুদিপার সামনেই পরীক্ষা। তাই ওকে আমার মায়ের কাছে রেখেই রওনা দিলাম।

এর মাঝেই ট্রেন চলতে শুরু করেছে।একটু আগেই নিশিতা টয়লেট থেকে আরেক প্রস্ত সেজে আসল। নিশিতার শুধু সাজার বাতিক। যেখানেই যাবে সাথে করে নিয়ে যাবে মেকাপ বক্স। ট্রেনে উঠেই তাই সাজার কাজটা আবার সেড়ে আসতেই আমি গেলাম টয়লেটে। গিয়ে মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে আয়নার দিকে তাকাতেই দেখতে পেলাম জিনিসটা। আর কিছুই না- মাথার উপর হালকা আলোর রেখার ভেতরে হলদে একটা রশ্মি নেচে নেচে ঘুরছে। দেখেই মাথাটা খানিক টা চক্কর মেরে উঠল। আমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছি?? আমি আবার পানির ঝাপটা দিলাম। মনে মনে বললাম- আমি যা দেখছি- সব মিথ্যা-সব হ্যালুসিনেশন। কিন্তু চোখ মেলে আবার দেখতে পেলাম সেটাকে। আমার দিকে তাকিয়ে যেন তাচ্ছিল্যের হাসি দিচ্ছে বলয়টা। আমি ছুটে এলাম নিশিতার কাছে।এসে দেখি নিশিতা আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। ওর অনন্য সুন্দর মুখটার উপর একটা হালকা আলোর বলয়- ঠিক আমার তার মত। আমি প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেলাম খুব- দুই চোখে তাকালাম ট্রেনের বাকি যাত্রিদের উপর- দেখলাম প্রায় ৩০জন যাত্রির সবার মাথার উপর একটা করে আলাদা বলয় তৈরি হয়ে আছে। এই মুহূর্তে আমি নিশিতার দিকে তাকিয়ে আছি। অপেক্ষা করছি সামনে অপেক্ষমাণ মৃত্যুর জন্য। আর আমার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে হাসছে যেন নিশিতার মাথার উপর বলয়ের ভেতরকার হলদে আলোর রেখা.।.।


(সমাপ্ত)

No comments:

Post a Comment